ঘাটাইলে মৌখিক অনুমতিতেই চলে করাতকল

ঘাটাইলে মৌখিক অনুমতিতেই চলে করাতকল
সৈয়দ মিঠুন ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি: ঘাটাইলে মৌখিক অনুমতিতেই চলে করাতকল
নিষিদ্ধ ঘোষিত বনের শাল, গজারি গাছ কাটা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। তাই আজ ধ্বংসের পথে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সংরক্ষিত বনের শাল গজারি। এ জন্য কিছু অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী, বন কর্মকর্তা এবং বনের ভেতর গড়ে ওঠা শতাধিক অবৈধ করাতকল মালিককে দায়ী করলেন এলাকাবাসী। গতকাল রোববার (৩০ মে) সকাল ৮টার দিকে উপজেলার সরাবাড়ি বাজারের পাশে এক করাতকল থেকে ১১ টুকরো গজারি গাছ উদ্ধার করে বন বিভাগ।
রেঞ্জ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, করাতকল মালিক জাহিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। জাহিদ বলেন, ওই গজারি গাছের মালিক রসুলপুর ইউনিয়নের কাজলা গ্রামের জাহাঙ্গীর। তার করাতকলের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এ জন্য প্রতি মাসেই বন বিভাগের লোকদের পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা দিয়ে আমরা কল চালাই।
কিন্তু রেঞ্জ কর্মকর্তা টাকার বিষয়ে বলেন, ওইসব কথা ভিত্তিহীন। তার দাবি, ঘাটাইলের বিশাল এই বনভূমির তুলনায় আমাদের জনবল অনেক কম।
ধলাপাড়া রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ১৮০টি করাতকলের মধ্যে শতাধিকের কোনো লাইসেন্স নেই। কলগুলো আবার স্থাপন করা হয়েছে বনভূমি ও সংরক্ষিত বনভূমির ভেতরে। এসব কলে প্রতিনিয়ত চেরাই করা হচ্ছে গজারি গাছ। রাতের আঁধারে পাচার করা হচ্ছে কাঠ। ফলে দিন দিন উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনের শাল, গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দেখা দিচ্ছে পরিবেশের বিপর্যয়।
এ নিয়ে পত্রিকায় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ধলাপাড়া রেঞ্জ অফিসের ছয়টি বিটের আওতায় বনাঞ্চল রয়েছে ৮৮.৪৫ বর্গকিলোমিটার। ৪৯টি মৌজায় বনভূমি ও সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার একর। বিশাল এই বনভূমিতে শাল, গজারিসহ রয়েছে আকাশমণি, মেনজিয়াম, ইউক্যালিপটাস, সেগুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
বনের ভেতরে আবার কোথাও বন ঘেঁষে অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে ১০১টি করাতকল। অথচ বন আইন অনুসারে বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে করাতকল স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব করাতকল উচ্ছেদের জন্য একটি তালিকা প্রায় এক বছর আগে জমা দেন বন কর্মকর্তা।
মাস তিনেক আগে জেলা থেকে নিয়োগ করা একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসে বন বিভাগের সহায়তায় ১০১টির মধ্যে মাত্র পাঁচটি উচ্ছেদ করেন। এরপর আর অভিযান পরিচালিত হয়নি বলে জানান রেঞ্জ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম।
গত বছরের ৫ অক্টোবর উপজেলায় বন ও পরিবেশ কমিটির এক সভায় ৩৯ সদস্যের সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আগামী মাসিক সভার আগেই উচ্ছেদ করা হবে অবৈধ করাতকল। এরপর মাস চলে গেছে সাতটি, অনুষ্ঠিত হয়েছে মাসিক সভা; কিন্ত ঠিকই চলছে অবৈধ করাতকল।
বনাঞ্চলসহ পরিবেশ রক্ষায় উপজেলায় বন ও পরিবেশ কমিটি থাকলেও এ কমিটির কার্যক্রম চলছে শুধু কাগজেকলমে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রেঞ্জ ও বিট অফিসের নাকের ডগায় করাতকল স্থাপন করে দিনরাত বৈধ-অবৈধ কাঠ চেরাই চলছে। গোল কাঠ চেরাই করলে আর বোঝার উপায় থাকে না- এটা কী গাছ ছিল।
অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের লোকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এসব করাতকল চলতে পারে না। তারা নাকি দিনেও চলেন চোখ বন্ধ করে। কিন্তু রেঞ্জ কর্মকর্তা জানান, যেখানেই উচ্ছেদ করতে যাই সেখানেই সরকারি দলের বড় বড় নেতার ফোন আসে, মামলা এবং উচ্ছেদ না করতে দেওয়া হয় চাপ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক করাতকল মালিক জানান, লাইসেন্স না থাকলেও বন কর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতি নিয়ে চলছে বেশ কিছু করাতকল। বন বিভাগের লোকদের সঙ্গে নিয়েই আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা করে আসছি।
করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আ. হালিম বলেন, অবৈধ করাতকলের কারণে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বনও ধ্বংস হচ্ছে। বনের চোরাই গাছ চেরাই করে তারা কম দামে বিক্রি করতে পারে, যা আমরা পারি না।
এ বিষয়ে বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার সরকার বলেন, এভাবে শাল, গজারি কাটা হলে একদিন পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে। অবৈধ করাতকল উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি জানান, জেলা প্রশাসক থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু উচ্ছেদ করা হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন